নোয়াখালী ০৪:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মফস্বল সাংবাদিকের গল্প শোনার কেউ নেই

মতামত ডেস্ক
  • আপডেট সময় ০৫:৩১:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২২
  • / ১৫৫৮ বার পড়া হয়েছে

শওকত জামান

শওকত জামান

মফস্বল সাংবাদিকদের কষ্টমাখা জীবনের গল্প লিখতে বসেছি মাঠের সাংবাদিকতায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে। সংসারের টানাপোড়নের মুখেও প্রতিদিন হাসিমুখে সংবাদ সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ি মাঠে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, দুর্যোগের মধ্যেও করি দায়িত্ব পালন। গভীর থেকে সত্য বের করে আনতে কখনো নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাকে পেছনে ফেলে কাজ করে যাই। ভুলে যাই খাওয়া-দাওয়া। সঠিক তথ্য দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে অনেক সময় নিজের পরিবারের কথাও ভাবা হয় না। নিজের আরাম আয়েশ এমনকি বিশ্রামও ঠিকভাবে করতে পারি না। কারণ সাংবাদিকরা জাতির জাগ্রত বিবেক বলে কথা। তাই সব সময় জাগ্রত থাকতে হয়। দেশ ও দশের পাহারাদারের দায়িত্বে।

মানুষের কথা বলি, মানবতার কথা বলি। ক্ষুধার্ত-নিপীড়িত মানুষের কথা বলি। অন্যায়, অবিচার, অপরাধের কথা তুলে ধরি। আবার সরকারের উন্নয়নের কথাও তুলে ধরি। পোশাক শ্রমিক থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরের, সব পেশার মানুষদের প্রতি বৈষম্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন সাংবাদিকেরা৷ কিন্তু সেই সাংবাদিকেরা যখন নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন, তাদের দাবি আদায়ের রাস্তা খুবই সংকীর্ণ৷ বেতন বৈশম্যের শিকার হচ্ছি তার খবর কাকে বলবো? শোনারও কেউ নেই,বলারও জায়গা নেই।

মাঠের সাংবাদিকদের দীর্ঘশ্বাস কি পৌঁছে ঢাকার মিডিয়া হাউজে? কখনও কি জানতে চান কেমন করে চলছে আমাদের সংসার। পরিবারের ভরন মেটাচ্ছি বা কিভাবে। আমার মতো মফস্বলের সাংবাদিকরা মান সম্মানের প্রশ্নে মুখ ফুটে কারও কাছে বলতেও পারছেন না, আবার চলতেও পারছেন না। মফস্বল সাংবাদিকদের সংসার কিভাবে চলছে এ খবর কেউ নিচ্ছে কি? এর উত্তরে কী বলবো? কে খবর নেবে? মিডিয়া মালিক নাকি সরকার? প্রথমেই বলতে হয় যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই মিডিয়ার দায়িত্বই সবার চেয়ে বেশি। তারপরেও সরকারের ভূমিকাও কম নয়। মিডিয়া কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে কী বলবো? মিডিয়া সম্রাটরাই ভালো বলতে পারেন তারা সে দায়িত্বটুকু নুন্যতম পালন করছেন কি না?

আমি বলবো এই নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তাদের। তবে বিনা বেতনে শ্রম আদায় করে নিতে চুল পরিমান ছাড় নেই। পান থেকে চুন খসলেই কান ফাটনো গগন কাঁপানো ঝারি। বিনা বেতনে চাকরি নামক সোনার হরিনটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা। হায়রে পেশা! গ্রাম বাংলার লোক কথায় শোনা যায়, ভাত দেয়ার মুরদ নাই কিল মারার গোসাই।

হলুদ সাংবাদিক বানানোর দায় কি আমাদের? এ দায় মিডিয়া হাউজের কর্তৃপক্ষের। বিনা বেতনে শ্রম ও বিজ্ঞাপন আদায়ে আইডি কার্ড দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতা বা পারিবারিক সামাজিক খোঁজ খবর না নিয়েই। কোন কোন অসাধু মিডিয়া হাউজ কর্তৃপক্ষের নামে অভিযোগ শোনা যায়, অর্থের বিনিময়েও নাকি আইডি কার্ড বিতরণ করেন। তবে ওরা পেশাদার কোন প্রতিষ্ঠান নয়, অপেশাদার, বলতে পারি হলুদ সাংবাদিক বানানোর কারখানা। অথচ মাঠ পর্যায়ে প্রকৃত সাংবাদিকদের গালমন্দ শুনতে হচ্ছে হলুদ সাংবাদিকতা নিয়ে।

বেতন বৈশম্যের শিকারের পরও কষ্ট লাগে ঢাকায় মিডিয়া হাউজের মোটা বেতনে চাকরিরত বড় বড় পদে দায়িত্বদের যখন দেখি আমাদের মূল্যয়ন নিয়ে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য তির্যক ভাষায় মফস্বলের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিয়ে নানা মন্তব্য। অথচ মফস্বল মানেই সারা বাংলাদেশ। মফস্বলের সাংবাদিকদের খবরে ১২ পৃষ্ঠা, ১৬ পৃষ্ঠা ও ২০ পৃষ্ঠার পত্রিকার পাতা ভরে। পত্রিকাটি পরিপূর্ণ হতে মফস্বলের খবর ছাড়া হবে? হবে না।

মিডিয়া হাউজের দারোয়ানের সমান বেতন না পেলেও দিনরাত খবর সংগ্রহ করে পরিবেশন করি মিডিয়া হাউজে হাসিমুখে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকতে হয় সংবাদের খোঁজে। কখন বাড়ি ফিরবো তাও জানি না। সারাদিন খবরের পেছন পেছন ছুটি। নানান উৎকণ্ঠায় থাকে আমার পরিবার। কী না কী হয়। কত উৎকণ্ঠা। সঙ্গ পায় না, একা একা খাওয়া খায়। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে, কখন বাড়িতে ফিরি। আমার তো নিরাপত্তা নেই। পরিবারের আপত্তি, কেন সাংবাদিকতা করি।

মাঝে মাঝে জীবননাশের হুমকিও আসে। হামলাও হয়, মামলাও হয়। তবুও ভয় না করে কাজ করি। পদে পদে বিপদ তা জেনেও আমরা পিছপা হই না। ঝুঁকি থাকা সত্বেও আমি নির্ভিক, আমি সৈনিক। সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। সে দর্পণ সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেই রাষ্ট্রের কাজে নিবেদিত করেছি নিজেকে। নিজের জন্য নয় মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি এটাই সার্থকতা।

আমার তোলা একটি ছবি, কিংবা আমার একটি লেখার দ্বারা হয়তো অনেকেরই ভাগ্যের দ্বার খুলে যায়। মানবতার অধিকার খুঁজে পায়। নির্যাতিত, নিপীড়িতরা বিচার পায়। এটাই আমরা সার্থকতা। এটা নিয়েই আমি মনের শান্তি খুঁজে ফিরি। পরিশ্রম আর বিনা বেতনে কি সুন্দর আমাদের জীবন। দিনশেষে হাসিমুখে মেনে নিতে হয় সব কিছু। এভাবেই যাচ্ছে আমাদের দিনকাল। তবুও বলবো ভালো থাকুক সবাই। ভালো থাকুক আমার স্বাধীন বাংলাদেশ।

আমি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমকর্মী। আমি অতি সামান্য হলেও একজন দায়িত্বশীল সচেতন নাগরিক। আমার উপর রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্ব। শুধু কি আমার রাষ্ট্রের প্রতি আমারই দায়িত্ব? রাষ্ট্রের কি আমার প্রতি কোন দায়িত্ব নেই? মিডিয়া হাউজের কর্তৃপক্ষও দায়িত্ব নিয়েছেন, না ভাবছেন আমাদের কথা। তাই আমাদের টানাপোড়নের জীবনের গল্প শুনার কেউ নেই, বলারও জায়গা নেই।

শওকত জামান, সাংবাদিক, জামালপুর

নিউজটি শেয়ার করুন

মফস্বল সাংবাদিকের গল্প শোনার কেউ নেই

আপডেট সময় ০৫:৩১:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২২

শওকত জামান

মফস্বল সাংবাদিকদের কষ্টমাখা জীবনের গল্প লিখতে বসেছি মাঠের সাংবাদিকতায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে। সংসারের টানাপোড়নের মুখেও প্রতিদিন হাসিমুখে সংবাদ সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ি মাঠে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, দুর্যোগের মধ্যেও করি দায়িত্ব পালন। গভীর থেকে সত্য বের করে আনতে কখনো নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাকে পেছনে ফেলে কাজ করে যাই। ভুলে যাই খাওয়া-দাওয়া। সঠিক তথ্য দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে অনেক সময় নিজের পরিবারের কথাও ভাবা হয় না। নিজের আরাম আয়েশ এমনকি বিশ্রামও ঠিকভাবে করতে পারি না। কারণ সাংবাদিকরা জাতির জাগ্রত বিবেক বলে কথা। তাই সব সময় জাগ্রত থাকতে হয়। দেশ ও দশের পাহারাদারের দায়িত্বে।

মানুষের কথা বলি, মানবতার কথা বলি। ক্ষুধার্ত-নিপীড়িত মানুষের কথা বলি। অন্যায়, অবিচার, অপরাধের কথা তুলে ধরি। আবার সরকারের উন্নয়নের কথাও তুলে ধরি। পোশাক শ্রমিক থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরের, সব পেশার মানুষদের প্রতি বৈষম্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন সাংবাদিকেরা৷ কিন্তু সেই সাংবাদিকেরা যখন নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন, তাদের দাবি আদায়ের রাস্তা খুবই সংকীর্ণ৷ বেতন বৈশম্যের শিকার হচ্ছি তার খবর কাকে বলবো? শোনারও কেউ নেই,বলারও জায়গা নেই।

মাঠের সাংবাদিকদের দীর্ঘশ্বাস কি পৌঁছে ঢাকার মিডিয়া হাউজে? কখনও কি জানতে চান কেমন করে চলছে আমাদের সংসার। পরিবারের ভরন মেটাচ্ছি বা কিভাবে। আমার মতো মফস্বলের সাংবাদিকরা মান সম্মানের প্রশ্নে মুখ ফুটে কারও কাছে বলতেও পারছেন না, আবার চলতেও পারছেন না। মফস্বল সাংবাদিকদের সংসার কিভাবে চলছে এ খবর কেউ নিচ্ছে কি? এর উত্তরে কী বলবো? কে খবর নেবে? মিডিয়া মালিক নাকি সরকার? প্রথমেই বলতে হয় যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই মিডিয়ার দায়িত্বই সবার চেয়ে বেশি। তারপরেও সরকারের ভূমিকাও কম নয়। মিডিয়া কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে কী বলবো? মিডিয়া সম্রাটরাই ভালো বলতে পারেন তারা সে দায়িত্বটুকু নুন্যতম পালন করছেন কি না?

আমি বলবো এই নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তাদের। তবে বিনা বেতনে শ্রম আদায় করে নিতে চুল পরিমান ছাড় নেই। পান থেকে চুন খসলেই কান ফাটনো গগন কাঁপানো ঝারি। বিনা বেতনে চাকরি নামক সোনার হরিনটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা। হায়রে পেশা! গ্রাম বাংলার লোক কথায় শোনা যায়, ভাত দেয়ার মুরদ নাই কিল মারার গোসাই।

হলুদ সাংবাদিক বানানোর দায় কি আমাদের? এ দায় মিডিয়া হাউজের কর্তৃপক্ষের। বিনা বেতনে শ্রম ও বিজ্ঞাপন আদায়ে আইডি কার্ড দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতা বা পারিবারিক সামাজিক খোঁজ খবর না নিয়েই। কোন কোন অসাধু মিডিয়া হাউজ কর্তৃপক্ষের নামে অভিযোগ শোনা যায়, অর্থের বিনিময়েও নাকি আইডি কার্ড বিতরণ করেন। তবে ওরা পেশাদার কোন প্রতিষ্ঠান নয়, অপেশাদার, বলতে পারি হলুদ সাংবাদিক বানানোর কারখানা। অথচ মাঠ পর্যায়ে প্রকৃত সাংবাদিকদের গালমন্দ শুনতে হচ্ছে হলুদ সাংবাদিকতা নিয়ে।

বেতন বৈশম্যের শিকারের পরও কষ্ট লাগে ঢাকায় মিডিয়া হাউজের মোটা বেতনে চাকরিরত বড় বড় পদে দায়িত্বদের যখন দেখি আমাদের মূল্যয়ন নিয়ে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য তির্যক ভাষায় মফস্বলের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিয়ে নানা মন্তব্য। অথচ মফস্বল মানেই সারা বাংলাদেশ। মফস্বলের সাংবাদিকদের খবরে ১২ পৃষ্ঠা, ১৬ পৃষ্ঠা ও ২০ পৃষ্ঠার পত্রিকার পাতা ভরে। পত্রিকাটি পরিপূর্ণ হতে মফস্বলের খবর ছাড়া হবে? হবে না।

মিডিয়া হাউজের দারোয়ানের সমান বেতন না পেলেও দিনরাত খবর সংগ্রহ করে পরিবেশন করি মিডিয়া হাউজে হাসিমুখে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকতে হয় সংবাদের খোঁজে। কখন বাড়ি ফিরবো তাও জানি না। সারাদিন খবরের পেছন পেছন ছুটি। নানান উৎকণ্ঠায় থাকে আমার পরিবার। কী না কী হয়। কত উৎকণ্ঠা। সঙ্গ পায় না, একা একা খাওয়া খায়। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে, কখন বাড়িতে ফিরি। আমার তো নিরাপত্তা নেই। পরিবারের আপত্তি, কেন সাংবাদিকতা করি।

মাঝে মাঝে জীবননাশের হুমকিও আসে। হামলাও হয়, মামলাও হয়। তবুও ভয় না করে কাজ করি। পদে পদে বিপদ তা জেনেও আমরা পিছপা হই না। ঝুঁকি থাকা সত্বেও আমি নির্ভিক, আমি সৈনিক। সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। সে দর্পণ সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেই রাষ্ট্রের কাজে নিবেদিত করেছি নিজেকে। নিজের জন্য নয় মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি এটাই সার্থকতা।

আমার তোলা একটি ছবি, কিংবা আমার একটি লেখার দ্বারা হয়তো অনেকেরই ভাগ্যের দ্বার খুলে যায়। মানবতার অধিকার খুঁজে পায়। নির্যাতিত, নিপীড়িতরা বিচার পায়। এটাই আমরা সার্থকতা। এটা নিয়েই আমি মনের শান্তি খুঁজে ফিরি। পরিশ্রম আর বিনা বেতনে কি সুন্দর আমাদের জীবন। দিনশেষে হাসিমুখে মেনে নিতে হয় সব কিছু। এভাবেই যাচ্ছে আমাদের দিনকাল। তবুও বলবো ভালো থাকুক সবাই। ভালো থাকুক আমার স্বাধীন বাংলাদেশ।

আমি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমকর্মী। আমি অতি সামান্য হলেও একজন দায়িত্বশীল সচেতন নাগরিক। আমার উপর রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্ব। শুধু কি আমার রাষ্ট্রের প্রতি আমারই দায়িত্ব? রাষ্ট্রের কি আমার প্রতি কোন দায়িত্ব নেই? মিডিয়া হাউজের কর্তৃপক্ষও দায়িত্ব নিয়েছেন, না ভাবছেন আমাদের কথা। তাই আমাদের টানাপোড়নের জীবনের গল্প শুনার কেউ নেই, বলারও জায়গা নেই।

শওকত জামান, সাংবাদিক, জামালপুর