অদৃশ্য জীবাণুর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ
- আপডেট সময় ০৩:৫৯:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২২
- / ১৫৬৮ বার পড়া হয়েছে
তুষার আবদুল্লাহ
দুনিয়া সফরে থাকা অদৃশ্য অনুজীবটির বাংলাদেশে এসে দশা আলেকজান্ডারের মতো। সেই ২০২০ থেকেই বলে যাচ্ছে– কী বিচিত্র এই দেশ! গোলকের অন্যত্র যেমন মানুষের পেছনে ছুটে হয়রান হয়, বাংলাদেশে সেই পেরেশান নেই। ভোল বা চরিত্র পাল্টালেও তাকে ছাড়তে রাজি নয় ব-দ্বীপের নাছোড়বান্দা মানুষগুলো। আলিঙ্গনে তাকে বাঁধবেই। ছুটে এসে এমন কঠিন করে জাপ্টে ধরবে যে, ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। অদৃশ্য জীবাণুর ও মায়ার শরীর, উদার মন, ছুটে আসে যারা, কাউকেই খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় না। অদৃশ্য জীবাণুর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ শুক্রবার স্বচক্ষে দেখলাম পূর্বাচলের পথে।
ব্যক্তিগত কাজে দুই বেলা যেতে হয়েছিল পূর্বাচল। বাণিজ্যমেলা শেরেবাংলা নগরের অস্থায়ী ঠিকানার বদলে স্থায়ী সাকিন পেয়েছে পূর্বাচলে। মেলা শুরুর পর থেকে আগের দুই শুক্রবার অন্য সময়ের চেয়ে পরিবহনের ভিড় বেশি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু গত শুক্রবার সেই ভিড় যেন রেকর্ড ছুঁয়ে গেছে। সকাল-বিকাল দুই বেলাতেই বাণিজ্যমেলা মুখি মানুষের স্রোত দেখতে পেলাম। সরকারের বরাদ্দ রাখা বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি অটোরিক্সা, মোটর সাইকেলে মানুষ ছুটেছে বাণিজ্যমেলার দিকে। তাদের এই ছুটে চলায় এক বিন্দু স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার লক্ষণ দেখা যায়নি। মেলা প্রাঙ্গণেও তাই। অথচ সেদিনই করোনা শনাক্তের হার ২৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেয়। সামাজিক অনুষ্ঠান, সমাবেশে বিধি-নিষেধ আনে। কিন্তু যাদের সুরক্ষার জন্য স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হলো, বাণিজ্যমেলা ও অন্যান্য বিপনী বিতানে সেই শিক্ষার্থীরাই ভিড় করেছিলেন দলবেঁধে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে। একই দিন পুরনো ঢাকা ও নতুন ঢাকার কিছু রেস্টুরেন্ট ও ব্র্যান্ডের দোকানের সামনে দিয়ে গিয়েছি। বাইরে থেকে দেখে নিজের কাছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে, শনাক্তের সংখ্যা এদেশে ১২ হাজার ছুঁয়েছে। গুলশান, বনানীর বিনোদন কেন্দ্রে ছিল ঈদ বিনোদনের আমেজ। এসব দেখে করোনার নিজেই পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না।
করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যতে নেমে আসার পর আমরা কলম্বাসের হাসি দিয়েছি। ভেবেছি পৃথিবীর সব দেশকে ছাড়িয়ে আমরা করেছি কোভিড জয়। অথচ তখনও বিশ্বের প্রায় সকল দেশই স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পাশাপাশি, কোভিডকে সমীহ দেখিয়ে আসছিল। কিন্তু বাংলাদেশ উড়েছে অহংকারের আকাশে। সরকারের দিক থেকে টিকা সহজলভ্য করা হয়েছে। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর বুস্টারও এখন সহজলভ্য। সরকার টিকা সহজ করেছে ঠিক, কিন্তু হাসপাতালগুলো দুই বছরেও কোভিড চিকিৎসার জন্য এখনও পুরো সক্ষম হয়ে উঠতে পারেনি। শনাক্ত করার পরীক্ষা এখনও সহজ হয়নি। বেসরকারি হাসপাতালের পরীক্ষার ফি কমেনি। একই সঙ্গে রিপোর্টও দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে না। করোনা রোগীদের চিকিৎসার আলাদা ব্যবস্থা এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ’র সংখ্যাও দুই বছরে বাড়েনি। বিশেষ করে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো স্বয়ং সম্পূর্ণ না হওয়ায় বা তাদের প্রতি আস্থা তৈরি না হওয়ায় রোগীরা ঢাকামুখি হচ্ছে। এতে রোগীর চিকিৎসা সময় মতো শুরু হচ্ছে না। জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে রোগী ঢাকার হাসপাতালে ভিড় করছে। ততক্ষণে ওই রোগী চিকিৎসার ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছেন। ঢাকাতেও জনসংখ্যা অনুপাতে কোভিড চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল।
এই অপ্রতুলতাকে মোকাবিলা করতে প্রয়োজন ছিল সচেতনতার। কিন্তু সেই অনুশীলনে আম মানুষের উদাসীনতা যেমন ছিল, তেমনই ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের। বিধি-নিষেধ যেভাবে দেওয়া হয়, সেখানে নানা প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে। চারদিন আগে প্রজ্ঞাপন দিয়ে কেন বলা হবে, চারদিন পর থেকে বিধি-নিষেধ? তার মানে ওই কয়দিন কোভিড বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। যেমন, রাত আটটার পর কোভিড জড়িয়ে ধরবে, তার আগে নয়? একবার বলা হলো পরিবহন চলবে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে, দিন দুই পরেই আবার পুরো যাত্রী নিয়ে পরিবহন চলাচলের নির্দেশনা। বাজার হাট, ফুটপাত, মেলা, সামাজিক অনুষ্ঠান উন্মুক্ত থাকলো, কোভিড সেখানে অভিযান না চালিয়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠলো গণপরিবহনে?
এ ধরনের নির্দেশনা জন মানুষকে আরো খামখেয়ালী হতে প্রণোদিত করছে নাতো? অস্থির চিত্তে নয়, শীতল মস্তিষ্কে এই সিদ্ধান্তগুলো প্রস্ফুটিত হওয়া প্রয়োজন।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী