জাগছে ৫০ হাজার হেক্টর চর, সন্দ্বীপ থেকে সড়কপথেই ভাসানচর
- আপডেট সময় ১১:৫৬:২৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২২
- / ১৫৩৮ বার পড়া হয়েছে
নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের দূরত্ব নৌপথে মাত্র চার কিলোমিটার। মধ্যবর্তী এই স্থানে পলি জমে জেগে উঠছে নতুন চর। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ভাসানচর স্থলপথে মিলবে সন্দ্বীপে। এতে দেশ পাবে নতুন ৫০ হাজার হেক্টর ভূমি। সেই ভূমি রক্ষায় করা হবে ব্যাপক বনায়ন। স্থলপথে দুই চরের মিলনে সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্যাটেলাইটে ধারণ করা চিত্রে দেখা যায়, সন্দ্বীপ ও ভাসানচরের কোলঘেঁষে পানির গভীরতা এক থেকে দুই ফুট। তবে কোথাও কোথাও গভীরতা প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত। নতুন পলিতে এসব গভীরতা ভরাট হয়ে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাসানচরে মিলে যেতে পারে সন্দ্বীপ। তখন আর নৌপথে নয় বরং সড়কপথেই দুই দ্বীপের সংযোগ স্থাপন হবে বলে দাবি বন বিভাগের। এমন আরও অনেক ডুবোচর রয়েছে, যেগুলো পলিতে ভরাট হয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জেগে ওঠার অপেক্ষায়।
নতুন জেগে ওঠা এসব চরের ভূমি যেন পানিতে বিলীন না হয় সেজন্য সরকারের ব্যাপক বনায়ন পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানায় বন বিভাগ সূত্র।
প্রতি বছর দেশে সাত থেকে আট হাজার হেক্টর চর জাগছে। নদীমাতৃক এ দেশে আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৭টি। এসব নদীর মাধ্যমে মেঘনার মোহনায় পলি জমছে। এতে একদিকে যেমন নতুন চর জাগছে অন্যদিকে বছর বছর প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে নদী ও সাগরগর্ভে হারাচ্ছে অনেক ভূমি। ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও পদ্মা নদী দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টন পলি বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। এ পলিমাটিতে জাগছে নতুন চর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চর জাগছে নোয়াখালীর হাতিয়া, ভাসানচর ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। জেগে ওঠা এসব চরের মাটির স্থায়িত্ব ধরে রাখতে বিশাল বনায়ন করা হচ্ছে। এতে অক্সিজেনের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমন রক্ষা পাচ্ছে জীববৈচিত্র্যও।
উপকূলীয় অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ খান জাগো নিউজকে বলেন, নদীর মাধ্যমে ভারত থেকে প্রচুর পলিমাটি প্রবেশ করে বাংলাদেশে। প্রতি বছর সাত থেকে আট হাজার হেক্টর চর জাগছে। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাসানচর ও সন্দ্বীপ চর দুটি একসঙ্গে মিলিত হবে। এতে বাংলাদেশ পাবে নতুন আরও ৫০ হাজার হেক্টর জমি। এসব জমির স্থায়িত্ব ধরে রাখতে আমরা ব্যাপক বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছি।
উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে বন বিভাগের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। ‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চরসহ উপকূলীয় এলাকার বনায়ন’ প্রকল্পের আওতায় নেওয়া হয়েছে এ উদ্যোগ। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বন অধিদপ্তর। প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। এ বনায়ন প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৪ কোটি ৮০ লাখ ২৬ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে আর ১০ মাসের মতো সময় বাকি। তবে গত চার বছরে এ প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৫৫ শতাংশ। ফলে বাকি সময়ে পুরো কাজ শেষ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যদিও বন অধিদপ্তর এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর (২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত) বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে।
এ বনায়ন প্রকল্পের আওতায় ৪০ হাজার বসতবাড়ির মধ্যে চলতি অর্থবছর (২০২১-২২) পর্যন্ত ৩০ হাজার বাড়িতে চারা রোপণ শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ২১ হাজার ৫১৪টি বসবাড়িতে চারা রোপণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের সময় বাড়ার পাশাপাশি মোট ব্যয়ও বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি প্রথমে ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন চরে বনায়ন বাড়ানোয় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
এ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালীর সদর উপজেলা, দুমকি, গলাচিপা, কলাপাড়া, মির্জাগঞ্জ ও রাঙ্গাবালী, বরগুনার সদর উপজেলা, আমতলী, বামনা, বেতাগী, পাথরঘাটা ও তালতলী; পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও ভান্ডারিয়া, ভোলার সদর উপজেলা, বোরহানউদ্দিন, চরফ্যাশন, দৌলতখান, লালমোহন, মনপুরা, তজুমদ্দিন; নোয়াখালীর সদর উপজেলা, বেগমগঞ্জ, চাটখিল, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, সেনবাগ, সুবর্ণচর, সোনাইমুড়ী, কবিরহাট এবং লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলা, রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগরে বনায়নের পরিধি বাড়বে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম
২৫ হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন, এক হাজার কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান সৃজন, ৪০ হাজার বসতবাড়িতে বনায়ন, পাঁচ হাজার উপকারভোগীকে সামাজিক বনায়ন ও বাগান সৃজন কৌশল এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন নিরসনের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া।
বাড়ছে মেয়াদ বাড়ছে বনায়নের পরিধি
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ব্যয়ও। সমুদ্রের বুকে বা মোহনায় নতুন জেগে ওঠা চরের পরিমাণে উপজেলাভিত্তিক বিভাজনের কারণে তারতম্য হয়। ফলে কোম্পানীগঞ্জ, রামগতি, টেকনাফ, সীতাকুণ্ড, সোনাগাজী ও মঠবাড়িয়াসহ মোট ছয়টি উপজেলার পরিবর্তে হাতিয়া, সুবর্ণচর, রাঙ্গাবালী, চরফ্যাশন, তজুমদ্দীন ও সন্দ্বীপে বনায়ন করা হবে। এছাড়া ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, দাগনভূইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজী, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও পেকুয়ায় বনায়ন করা হবে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা
নতুন চর জেগে ওঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাসে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাসে কার্বনের মজুত বাড়ানো এবং আবাসস্থল ও প্রজনন সুবিধার উন্নয়নের মাধ্যমে সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের জীববৈচিত্র্য বাড়ানো।
ভূমি মন্ত্রণালয় জানায়, দেশে অনেকে এখনো ভূমিহীন। জেগে ওঠা চরে ছয় হাজার ভূমিহীন দরিদ্র পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ‘চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলমান প্রকল্পটি চলতি বছরের (২০২২) জুন মেয়াদে শেষ হবে। এ প্রকল্পের আওতায় চার হাজার ৩০০ একর ভূমির প্লট টু প্লট জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে এবং ১৬০টি ভূমিহীন পরিবার বাছাই করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে জেগে ওঠা চরে ঠাঁই খুঁজে পাবে এসব ভূমিহীন পরিবার।
গত একশো বছরে নতুন জেগে ওঠা চরের তালিকায় নোয়াখালী উপকূলের নিঝুমদ্বীপ, নলেরচর ও কেয়ারিংচর, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে উড়ির চর ও পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে ভাসানচরসহ রয়েছে আরও অনেক দ্বীপ।
প্রায় দুই দশক আগে জেগে ওঠা ভাসানচরে এরই মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কক্সবাজার থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। ভাসানচরের দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে জেগেছে ১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের গাঙ্গুরিয়ার চর। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এ চরে চাষাবাদ শুরু হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট-ব্রিজিং (সিডিএসপি-ব্রিজিং) প্রকল্পের পরিচালক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতিনিয়তই নতুন নতুন চর জাগছে। এসব চর ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় সরকার নানা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম ভূমিহীন পরিবারগুলোর পুনর্বাসন। সে লক্ষ্যে নতুন চরগুলোতে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।