নোয়াখালী ০১:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আলোচিত সেই জজ মিয়া আত্মগোপনে!

বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় ০৮:৫৩:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৪
  • / ১২৭৯ বার পড়া হয়েছে

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন জজ মিয়া নামে এক ব্যক্তি। তাকে নিয়ে দেশ-বিদেশে হয়েছে নানা আলোচনা। এই মামলায় শুরুতে অন্যতম আসামি করা হয়েছিল তাকে। দীর্ঘদিন ছিলেন কারাগারের কনডেম সেলে।

সরকার পরিবর্তনের পর ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে মামলার চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয় জজ মিয়াকে। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর থেকে তার খোঁজ মিলছে না।

রোববার (১ ডিসেম্বর) বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন পাওয়া সব আসামিকে খালাস দিয়েছে হাইকোর্ট।

সেই সঙ্গে এর আগে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় এবং মামলার অভিযোগপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার পর তার খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায় তিনি নিখোঁজ। তার মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশ না করে তার এক স্বজন বলেন, জজ মিয়া ২০০৪ সালের আগস্টের পর থেকেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন। ঘটনার পর গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তকারী সংস্থা তাকে আটক করে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। ওই সময় তাকে রাজসাক্ষী বানানোর কথা বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়।

জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদসহ সন্ত্রাসীরা জড়িত। তাছাড়া সন্ত্রাসী রবিন, শফিক, বকুল, হাশেম, লিংকন, আনু, মুকুল, জাহিদ, জয়ও এই ঘটনায় জড়িত। হামলায় নেতৃত্ব দেয় বাড্ডার সন্ত্রাসী মুকুল।’

পরে তাকে কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়। নোয়াখালীর সেনবাগে থাকা তার মা ও বোনকে ভরণ-পোষণ দেওয়া হতো। ওয়ান ইলেভেনের সময় জজ মিয়া মুক্ত হন। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। আদালতে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন। ফলে আদালত রায়ও দিয়েছিল।

ওই স্বজন আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে জজ মিয়া তার স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় থাকতেন। ধানমন্ডিতে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জজ মিয়ার খোঁজ পাচ্ছি না আমরা। পরিবারসহ তিনি কোথায় আছেন তাও জানি না। গ্রামের বাড়িতেও যান না কয়েক বছর ধরে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোববার উচ্চতর আদালতে রায়ে সব আসামি খালাস পেয়েছেন। এখন তো সে আরও বেশি গোপনে থাকবেন বলে মনে হচ্ছে। আসলে তার ভাগ্যটাও খারাপ।

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জজ মিয়াকে খুঁজে আসছি। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের বাড়িতেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ তাকে পাওয়া গেলে অনেক কিছু উদঘাটন করা যেত। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে দিয়ে রাজনীতিবিদদের ফাঁসিয়েছে।

মাস সাতেক আগে জজ মিয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘অভাব-অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। পাশাপাশি আতঙ্কে থাকেন সার্বক্ষণিক। ভয়ে বাসার ঠিকানা দিচ্ছেন না কাউকে। টাকার অভাবে মায়ের চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারেননি। বোনের বিয়ের প্রস্তাব এলেও অর্থের অভাবে দেওয়া যায়নি। তবে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস থেকে আমাকে সহায়তা করত। এর আগে সিআইডি থেকেও পরিবারকে ভরণ- পোষণ দিয়েছিল।’

জজ মিয়া বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রায় ৯ মাস পর একদিন বিকেলে নোয়াখালীর সেনবাগের বীরকোট গ্রামের রাজা মিয়ার দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় সেনবাগ থানা পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। এরপরই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) হাতে তুলে দেয়। পরে আমাকে তারা নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের ভয়ভীতি দেখিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে।

তিনি বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে গুলিস্তানে সিডির ব্যবসা করতাম। থাকতাম টিকাটুলির একটি মেসে। একদিন ডিবি পুলিশ এসে অভিযান পরিচালনা করে। অস্ত্র-বোমা পায়। আমি মেসে থাকায় সন্দেহভাজন হিসেবে আমাকে আসামি করে। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় অস্ত্র মামলায় বেকসুর খালাস দেয় আদালত। একইভাবে বিস্ফোরক মামলা শেষ হয়ে যাবে আদালতে আসার দরকার নেই বলে আইনজীবী জানান। এ কারণে আর আদালতে না যাওয়ায় মামলায় সাজা হয়ে যায়। মূলত প্রথমে ওই মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আমাকে দিয়ে সাজানো হয় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা।

জানা যায়, জজ মিয়ার বর্তমান বয়স ৪৫-এর মতো। তার আসল নাম মোহাম্মদ জালাল। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগ থানার বীরকোট এলাকায়। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি মেজ। ১৫ বছর আগে তার বাবা আব্দুর রশিদ মারা যান। প্রায় চার বছর আগে মা জোবেদা খাতুনও মারা গেছেন।

২০০৮ সালের ১১ জুন সিআইডির দাখিল করা চার্জশিটে মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। আতঙ্কে বাড়ি থেকে মা ও বোনকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। বেশ কিছুদিন শনির আখড়ায় সাইনবোর্ড এলাকায় থাকেন।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে ভাড়া বাসায় থাকেন। একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাদের সংসারে জাহানারা আক্তার সুমাইয়া নামে একটি সন্তান আছে। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন জজ মিয়া। বিনাদোষে দীর্ঘ ৫ বছর কারাবাসের পর জামিনে মুক্ত হন তিনি। মামলার খরচ জোগান দিতে বিক্রি করতে হয়েছে বাবার রেখে যাওয়া ভিটেমাটিও।

নিউজটি শেয়ার করুন

আলোচিত সেই জজ মিয়া আত্মগোপনে!

আপডেট সময় ০৮:৫৩:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৪

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন জজ মিয়া নামে এক ব্যক্তি। তাকে নিয়ে দেশ-বিদেশে হয়েছে নানা আলোচনা। এই মামলায় শুরুতে অন্যতম আসামি করা হয়েছিল তাকে। দীর্ঘদিন ছিলেন কারাগারের কনডেম সেলে।

সরকার পরিবর্তনের পর ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে মামলার চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয় জজ মিয়াকে। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর থেকে তার খোঁজ মিলছে না।

রোববার (১ ডিসেম্বর) বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন পাওয়া সব আসামিকে খালাস দিয়েছে হাইকোর্ট।

সেই সঙ্গে এর আগে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় এবং মামলার অভিযোগপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার পর তার খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায় তিনি নিখোঁজ। তার মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশ না করে তার এক স্বজন বলেন, জজ মিয়া ২০০৪ সালের আগস্টের পর থেকেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন। ঘটনার পর গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তকারী সংস্থা তাকে আটক করে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। ওই সময় তাকে রাজসাক্ষী বানানোর কথা বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়।

জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদসহ সন্ত্রাসীরা জড়িত। তাছাড়া সন্ত্রাসী রবিন, শফিক, বকুল, হাশেম, লিংকন, আনু, মুকুল, জাহিদ, জয়ও এই ঘটনায় জড়িত। হামলায় নেতৃত্ব দেয় বাড্ডার সন্ত্রাসী মুকুল।’

পরে তাকে কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়। নোয়াখালীর সেনবাগে থাকা তার মা ও বোনকে ভরণ-পোষণ দেওয়া হতো। ওয়ান ইলেভেনের সময় জজ মিয়া মুক্ত হন। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। আদালতে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন। ফলে আদালত রায়ও দিয়েছিল।

ওই স্বজন আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে জজ মিয়া তার স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় থাকতেন। ধানমন্ডিতে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জজ মিয়ার খোঁজ পাচ্ছি না আমরা। পরিবারসহ তিনি কোথায় আছেন তাও জানি না। গ্রামের বাড়িতেও যান না কয়েক বছর ধরে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোববার উচ্চতর আদালতে রায়ে সব আসামি খালাস পেয়েছেন। এখন তো সে আরও বেশি গোপনে থাকবেন বলে মনে হচ্ছে। আসলে তার ভাগ্যটাও খারাপ।

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জজ মিয়াকে খুঁজে আসছি। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের বাড়িতেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ তাকে পাওয়া গেলে অনেক কিছু উদঘাটন করা যেত। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে দিয়ে রাজনীতিবিদদের ফাঁসিয়েছে।

মাস সাতেক আগে জজ মিয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘অভাব-অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। পাশাপাশি আতঙ্কে থাকেন সার্বক্ষণিক। ভয়ে বাসার ঠিকানা দিচ্ছেন না কাউকে। টাকার অভাবে মায়ের চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারেননি। বোনের বিয়ের প্রস্তাব এলেও অর্থের অভাবে দেওয়া যায়নি। তবে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস থেকে আমাকে সহায়তা করত। এর আগে সিআইডি থেকেও পরিবারকে ভরণ- পোষণ দিয়েছিল।’

জজ মিয়া বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রায় ৯ মাস পর একদিন বিকেলে নোয়াখালীর সেনবাগের বীরকোট গ্রামের রাজা মিয়ার দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় সেনবাগ থানা পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। এরপরই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) হাতে তুলে দেয়। পরে আমাকে তারা নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের ভয়ভীতি দেখিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে।

তিনি বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে গুলিস্তানে সিডির ব্যবসা করতাম। থাকতাম টিকাটুলির একটি মেসে। একদিন ডিবি পুলিশ এসে অভিযান পরিচালনা করে। অস্ত্র-বোমা পায়। আমি মেসে থাকায় সন্দেহভাজন হিসেবে আমাকে আসামি করে। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় অস্ত্র মামলায় বেকসুর খালাস দেয় আদালত। একইভাবে বিস্ফোরক মামলা শেষ হয়ে যাবে আদালতে আসার দরকার নেই বলে আইনজীবী জানান। এ কারণে আর আদালতে না যাওয়ায় মামলায় সাজা হয়ে যায়। মূলত প্রথমে ওই মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আমাকে দিয়ে সাজানো হয় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা।

জানা যায়, জজ মিয়ার বর্তমান বয়স ৪৫-এর মতো। তার আসল নাম মোহাম্মদ জালাল। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগ থানার বীরকোট এলাকায়। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি মেজ। ১৫ বছর আগে তার বাবা আব্দুর রশিদ মারা যান। প্রায় চার বছর আগে মা জোবেদা খাতুনও মারা গেছেন।

২০০৮ সালের ১১ জুন সিআইডির দাখিল করা চার্জশিটে মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। আতঙ্কে বাড়ি থেকে মা ও বোনকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। বেশ কিছুদিন শনির আখড়ায় সাইনবোর্ড এলাকায় থাকেন।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে ভাড়া বাসায় থাকেন। একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাদের সংসারে জাহানারা আক্তার সুমাইয়া নামে একটি সন্তান আছে। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন জজ মিয়া। বিনাদোষে দীর্ঘ ৫ বছর কারাবাসের পর জামিনে মুক্ত হন তিনি। মামলার খরচ জোগান দিতে বিক্রি করতে হয়েছে বাবার রেখে যাওয়া ভিটেমাটিও।